‘কোনো এক উল্টো রাজা, উল্টো বুঝলি প্রজার দেশে, চলে সব উল্টো পথে, উল্টো রথে, উল্টো বেশে।’ নচিকেতার এই গানের মতোই উল্টো এক কর ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে পাকিস্তানে; যেখানে বড়লোকের চেয়ে গরিবকে করের বোঝা বইতে হয় বেশি।
পাকিস্তান বর্তমানে আইএমএফের স্ট্যান্ডবাই অ্যারেঞ্জমেন্ট (এসবিএ) প্রোগ্রামের সাথে যুক্ত, যার অধীনে পাকিস্তান এই বছরের জুলাইয়ে ১ বিলিয়ন ডলারের প্রথম কিস্তি পেয়েছে এবং দ্বিতীয় কিস্তিটি ২০২৩ সালের নভেম্বরে পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
আইএমএফ কর্তৃক আরোপিত শর্তগুলোর পাশাপাশি দেশটিতে কর সংগ্রহ বাড়ানোর একটি শর্তও রয়েছে, যাতে এটি পাকিস্তানের বাজেট ঘাটতি হ্রাস করতে পারে।
পাকিস্তানের অর্থনীতি ও কর বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের কর আদায় ব্যবস্থায় দরিদ্রদের কাছ থেকে বেশি কর আদায়ের কারণ দেশে পরোক্ষ করের প্রাচুর্য, যা সব ভোক্তার কাছ থেকে আদায় করা হয়, কিন্তু দরিদ্রদের আয় কম হওয়ার কারণে তাদের এই পরোক্ষ করের অনেক অতিরিক্ত বোঝা পড়ে।
পাকিস্তানে কর আদায় ব্যবস্থা কিভাবে কাজ করে?
পাকিস্তান ফেডারেল সরকারের একটি সহায়ক সংস্থা ফেডারেল বোর্ড অব রেভিনিউ (এফবিআর) সারা দেশে কর সংগ্রহের কাজ করে। প্রাদেশিক পর্যায়ে কর আদায়কারী সংস্থাগুলো কাজ করলেও জাতীয় পর্যায়ে এফবিআরই একমাত্র কর আদায়কারী সংস্থা।
আমরা যদি পাকিস্তানের কর ব্যবস্থার দিকে তাকাই, এটি আয়কর, ফেডারেল আবগারি শুল্ক, কাস্টমস ডিউটি এবং বিক্রয় করের মাধ্যমে করের অর্থ বা কর সংগ্রহ করে।
ফেডারেল অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৩০ জুন শেষ হওয়া অর্থবছরে পাকিস্তান ৭১৬৯ বিলিয়ন রুপি কর আদায় করেছে। আয়কর, বিক্রয় কর, ফেডারেল আবগারি শুল্ক এবং শুল্ক হিসাবে সংগ্রহ করা হয়েছে এই কর।
কর বিশেষজ্ঞ ড. ইকরাম-উল-হকের মতে, বর্তমানে পাকিস্তানে কর আদায়ের ৭০ শতাংশ পরোক্ষ কর থেকে সংগ্রহ করা হয়, যেখানে প্রত্যক্ষ কর থেকে সংগৃহীত কর মাত্র ৩০ শতাংশ।
পাকিস্তানে কে বেশি কর দেয়?
বর্তমানে পাকিস্তানের জনসংখ্যা প্রায় ২৪ কোটি। এর মধ্যে করদাতার সংখ্যা মাত্র ৪৫ লাখ। এখন প্রশ্ন ওঠে শুধু এই ৪৫ লাখ মানুষই কি কর দেয়?
আসলে ব্যাপারটি হলো পাকিস্তানের প্রতিটি নাগরিক বর্তমানে কর প্রদান করছেন। প্রধানত দেশে পরোক্ষ করের উচ্চ হারের কারণে তারা সবাই কর প্রদান করছেন।
কর বিশেষজ্ঞ জিশান মার্চেন্টের মতে, দেখা যাচ্ছে যারা মোবাইল ব্যবহার করছেন বা দোকানে যাচ্ছেন এবং কিছু কিনছেন তারা সবাই সরকারকে বিক্রয় কর দিচ্ছেন।
তিনি বলেন, আয়ের ওপর কর প্রদানের ক্ষেত্রে কর ব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণের মধ্যে আস্থার অভাব এবং কর ব্যবস্থার জটিলতা ও উচ্চ করহারের কারণে পাকিস্তানে কর প্রদানের সংস্কৃতি গড়ে উঠতে পারেনি।
তিনি বলেন, পাকিস্তানের জনসংখ্যার নিরিখে মাত্র দুই শতাংশ মানুষ কর দিচ্ছে, যা কমপক্ষে চার থেকে পাঁচ শতাংশ হওয়া উচিত।
পাকিস্তানে ধনীদের চেয়ে দরিদ্ররা কি বেশি কর দিচ্ছে?
পাকিস্তানের কর ও অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এটা সত্য যে পাকিস্তানে দরিদ্রদের ওপর করের বোঝা বেশি, যখন ধনী শ্রেণীর ওপর করের বোঝা তার চেয়ে কম।
কর বিশেষজ্ঞ ড. ইকরাম-উল-হক বলেন, বর্তমানে পাকিস্তানের কর রাজস্বের ৩০ শতাংশ প্রত্যক্ষ কর থেকে আসে এবং ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কর পরোক্ষ কর থেকে সংগ্রহ করা হয়।
তিনি বলেন, পরোক্ষ কর অবশ্যই ভোক্তাদের কাছ থেকে নেওয়া হয়, যার মধ্যে ধনী ও দরিদ্র উভয়ই রয়েছে, তবে দরিদ্রদের সীমিত আয়ের কারণে এই করের বোঝা তাদের ওপর বেশি, যখন ধনীদের উচ্চ আয়ের কারণে দরিদ্র ভোক্তার মতো তাদের ওপর এই করের বোঝা নেই।
তিনি বলেন, পাকিস্তানে আয় বাড়লেও মানুষ খুব বেশি কর দেয় না এবং বাস্তবায়িত কর আদায় ব্যবস্থা নিম্ন আয়ের মানুষকে বেশি প্রভাবিত করে।
তিনি বলেন, এর একটি উদাহরণ এমনভাবে দেওয়া যেতে পারে যে, কোনো ঠিকাদার বা রফতানিকারক বা আমদানিকারকের ওপর অগ্রিম কর আরোপ করা হলেও তিনি তা তার মুনাফা থেকে বের না করে সাধারণ ভোক্তার দিকে ঠেলে দেন।
অর্থনীতিবিদ হাজিমা বুখারি এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রত্যক্ষ করের বাস্তবায়ন বেশি হলে এবং পরোক্ষ করের হার কম করে ধনীদের ওপর বেশি কর আরোপ করা যেতে পারে। বর্তমানে যে কর আইন রয়েছে তাতেও এই প্রত্যক্ষ করগুলোর ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে, যখন প্রত্যক্ষ করগুলো দেশে সম্ভাব্য হারে আদায় করা হচ্ছে না।
সেক্টরাল ট্যাক্সের অবস্থা কী?
পাকিস্তানের বিভিন্ন খাত থেকে ভিন্ন হারে কর আসে। শিল্প খাত জিডিপির ২০% অবদান রাখে, তবে এর করের অংশ ২৮%।
জিডিপির ২৮ শতাংশ কৃষি খাত থেকে আসে, কিন্তু কর হার মাত্র ১ শতাংশ। একইভাবে দেশের পাইকারি ও খুচরা খাত দেশের জিডিপিতে ১৯ শতাংশ অবদান রাখলেও এ খাত থেকে সংগৃহীত করের হার এক শতাংশেরও কম।
এ প্রসঙ্গে ড. ইকরাম বলেন, পাকিস্তানে কৃষি খাতের করের অংশ মাত্র ৩শ কোটি রুপি। তিনি বলেন, শিল্প খাতও মাঝে মাঝে কম কর দেওয়ার চেষ্টা করলেও কৃষি খাতের তুলনায় এখনও করের হার অনেক বেশি।
স্থানীয় একটি ট্যাক্স ফার্মের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, একজন কৃষিজীবী যার বার্ষিক আয় আড়াই কোটি টাকা পর্যন্ত, তিনি মাত্র কয়েক হাজার টাকা কর দিচ্ছেন, অন্যদিকে একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের একজন ব্যক্তি যার বার্ষিক আয় ৪০ লাখের কিছু কম-বেশি, তাকে এর চেয়ে বেশি কর দিতে হয়।